প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, June 24, 2011

বেগম রোকেয়ার স্মৃতি ।। সুফিয়া কামাল

বেগম রোকেয়ার সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন ত আমি ছোট। ৬/৭ বছর বয়স, সাত বছর হয়ে গেছে। বেগম রোকেয়ার দারুণ প্রভাব আমার জীবনে। তাই তাঁর প্রসঙ্গে কিছু বিস্তারিত কথা বলবো। আম্মাকে ফুফু আম্মা ডাকতেন বেগম রোকেয়া। রক্তের সম্পর্ক কি না জানি না, তবে কুটুম্বিতা ছিল। তা কোলকাতায় আমরা গেছি তখন আমি ছোট, ৭ বছর হবে। একদিন শুনি যে স্কুলের গাড়ী এসেছে ‘ইস্কুলকা গাড়ী আয়া’ বলে হাঁক। তা দেখি যে এক মস্ত গাড়ী এসেছে। আম্মা, খালা-আম্মা সবাই বারান্দায় বসে আছেন। দেখি যে ছোটখাট সুন্দর একটি মেয়ে মানুষ উঠে আসছেন। তা উঠে এসে পরপর আম্মাকে, খালাম্মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। ‘রুকু’ তুমি কোলকাতায় আছ, আসনা যে? জী হ্যাঁ, আমি ত কোলকাতায়ই আছি। আমি ত আসি না কিন্তু আপনারাই বা আমার কত খবর নেন? বললেন উনি হাসি মুখেই। উনি ইস্কুল টিস্কুল করেছিলেন বলে ত মুসলমান সমাজের যত বড় বড় ঘরের সাথে আত্মীয়তা ওনার। প্রায় সবাই উনাকে আবিষ্কার করতে চাইত, এই রকম অবস্থা। তারপরে বসলেন। আমি ওখান দিয়ে যাচ্ছি—আম্মা বললেন, ‘সালাম কর, তোমার আপা হয়।’ আমিও সালাম করলাম। উনি আম্মাকে বললেন, ‘ফুফু আপনার মেয়ে?’ আম্মা বললেন, হ্যাঁ। তখন উনি বললেন, ‘আমার ইস্কুল ত আমি করেছি, সেখানে অনেক মেয়ে পড়ে, হিন্দু-মুসলমান সব মেয়েরা পড়ে, কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজনের কোনো মেয়ে আমার স্কুলে পড়ে না।’
রওশন জাহান, খুরশীদ জাহান আমার চেয়ে বয়সে বড়, আমার খালাত ভাইয়ের মেয়ে। খালা-আম্মার ছেলের মেয়ে। ওদের কথা বললেন যে, ওদেরকে লেখাপড়া শিখান না—, আমার স্কুলে যদি দেন। এইত পর্দা ঢাকাইত গাড়ী। গাড়ীতে পর্দার মধ্যেইত আসবে যাবে। অনেক মুসলমান মেয়েরা যখন আসছে। মেয়েদের দিলে খুশী হতাম। আম্মাকে বললেন ‘ওকে পড়াবেন’? আম্মা বললেন, ‘আমি ত কোলকাতায় থাকি না। আমি ত এসেছি আবার ক’মাস পরেই চলে যাব। মাস দু’তিন থাকব। নয়ত তোমার স্কুলে দিতাম পড়তে।’ আমার খুবই ইচ্ছা তখন থেকে আমি যদি পড়তে পারতাম। কি জানি ছোটবেলা থেকে স্কুলে ত কোনোদিন যাই নাই। যাবার একটা ইচ্ছা ছিল। আমি আম্মাকে বলেছি, আম্মা স্কুলে যাব। আম্মা বললেন আমরাত থাকব না, না হলে তোমাকে স্কুলে দিতাম। তা আমরা আবার একদিন সেই বন্ধ গাড়ীতে চড়ে স্কুলে গিয়ে দেখে টেখে এলাম। তখন স্কুলটা ছিল লোয়ার সার্কুলার রোডে। এখন ত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল লর্ড সিনহা রোডে।
শুনলাম ওরা—আমার খালাত ভাইয়ের মেয়েরা স্কুলে যাবে। আমার ত এত দুঃখ লাগল যে, ওরা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যেতে পারব না। আমরা যে চলে আসব শায়েস্তাবাদে। তারপর অবশ্য ওদেরও আর স্কুলে যাওয়া হল না। কারা কারা যেন বললো, হ্যাঁ এখন আর স্কুলে যায় নাই—একজন ইউরোপীয়ান গভর্নেস ওদের পড়াত। তা বেগম রোকেয়া বললেন যে, ইউরোপীয়ান গভর্নেস বাড়ীতে পড়ায়, কিন্তু আমার স্কুলে আমার আত্মীয়স্বজনের মেয়েরা নাই। এই কথাটা আমার এখনও মনে আছে। তারপরে ত আমরা শায়েস্তাবাদে চলে এলাম। তারপরে যখন আবার কোলকাতায় আসি তখন ত আমি বড় হয়েছি, বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে। তখন এসে আবার ওনার সঙ্গে দেখা। তখন উনি বললেন, ‘ফুলকবি’ তুই ত লেখাপড়া শিখিলি না, কিন্তু কবি ত হয়ে গেলি। আম্মাকে বললেন, ফুফু এই মেয়েটাকে যদি পড়াতেন তবে আজকে এই মেয়েটা কত লায়েক হত। আম্মা বললেন কি করব? আমাদের সময় ত আমরা শায়েস্তাবাদে থাকলাম। কলকাতায় ত থাকি নাই, কি করে পড়াব?
উনি আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম বলে একটা সমিতি করেছিলেন, তাতে হিন্দু-মুসলমান সব মেয়েরা সেই সমিতির সভ্য ছিল। তা ওখানে আমিও সভ্য হলাম। মরিয়ম আপাও ছিলেন। বুলু ও আমি ত অবশ্য তখন বড় হয়ে গেছি। লেখাপড়া আর কি শিখব। প্রায়ই তবু আমরা যেতাম। উনিও আসতেন প্রায়ই আমাদের ওখানে। তা আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলামে সব বাংলা নাম দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের উপর, বাংলা ভাষার উপর, বাংলা জাতির উপরে কি রকম যে ওনার একটা টান ছিল। আজকালকার দিনে কয়টা মানুষের সে রকম আছে আমি জানি না। সেই কালে উনি করলেন বাংলার মেয়েদের সমিতি, বাংলার খাওয়াতীনে ইসলাম, সব বাংলায় ওখানে। তবে ওনার যে স্কুলটা ছিল সেটা খালি স্কুল না। বেগম রোকেয়ার জীবনটা পড়লে দেখা যাবে ‘তারিণী ভবন’ বলে একটা কথা আছে তাতে। ‘পদ্মরাগ’ বলে একটা উপন্যাস উনি লিখেছেন। সেখানে তারিণী ভবনের উল্লেখ আছে। ওনার স্কুলটাই ছিল সেই তারিণী ভবন। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, ফার্সি সবরকম মেয়েরা পড়তো। কেউ শিক্ষয়িত্রী, কেউ সুপারিনটেনডেন্ট, কেউ পড়ছে, কেউ অনাথ, কেউ আসছে সেখানে থাকতে, কাজ করতে। এত সুন্দর প্রতিষ্ঠান আমি এখন পর্যন্ত আর কোথাও দেখি নাই। দেশে বিদেশে এ দেশের মেয়েরা কিম্বা অন্যান্য দেশের মেয়েরা মহিলারা কত সুন্দর সুযোগ-সুবিধা পায়, গভর্নমেন্টের সাহায্য পায়। কিন্তু উনি ত সে সব পেতেনইনা বরঞ্চ তখনকার দিনের সেই ধর্মান্ধ সমাজ ওনাকে গালাগালি করেছে। কত উড়া চিঠি লিখেছে। কতকরকম করে ওনাকে নির্যাতন করেছে। ঢিল মেরেছে। কিন্তু ওই স্কুল নিয়েই উনি ছিলেন। তা উনি নিজেই বলেছেন, আর আমরাও জানি ওনার ভাগলপুরে বিয়ে হয়েছিল সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। উনি মারা যাবার সময় ওনার কাবীনের টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই দশ হাজার টাকা দিয়ে উনি ভাগলপুরে প্রথমে একটা স্কুল করেন ওনার স্বামী মারা যাবার পরে।
উনি ছিলেন খলিল সাবের, ইব্রাহীম সাবেরের বোন। ওনার বাবার নাম ছিল জহীর উদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। পায়রাবন্দের সেই গ্রামের মধ্যে জমিদারের মস্ত বড় বাড়ী। ওখানে ত মেয়েরা ইস্কুল টিস্কুলে যেত না। ওনার দুই ভাই ইব্রাহীম সাবের আর খলীল সাবের বাড়ীতে যেতেন, তাঁদের কাছে বেগম রোকেয়া পড়াশুনা দেখতেন, তাঁদের কাছে পড়াশুনা উনি শিখতে চাইতেন। মোমবাতি জ্বালিয়ে রাতে চুপচাপ করে উনি সেখানে বসে পড়তেন।
তা ভাই দেখলেন যে উনি মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ছেন। বললেন, রুকু তুমি কি পড়ছ? আর উনি একদম ভয় পেয়ে গেলেন যে হয়ত নিষেধ হবে। তবে ভাই দেখলেন যে তার পড়বার খুবই আগ্রহ। তখন উনি ভাইয়ের কাছে লেখাপড়া শিখতে লাগলেন। এখন ত সব ভেঙে গেছে পায়রাবন্দ গ্রামের। কিন্তু ওইখানে আমি ওনার একটা স্মৃতিফলক রেখে এসেছি। যদি দেশের মেয়েরা ওনার স্মৃতিফলকটাকে বাঁচিয়ে রেখে সেইটির উন্নতি করে তা হলে তাঁর স্মৃতি রক্ষা সম্ভব হবে। ওনার জন্মভূমির একটা পাথর ওখানে বসিয়ে এসেছি। মিসেস আয়শা জাফর, আমি, আরও কয়েকজন মহিলা যাদের নিয়ে আমাদের ওই ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কমিটি’; সেই সমিতি থেকে ওনার নামের একটা পাথর আমি ওখানে বসিয়ে এসেছি। তা যাক সে কথা, এখন দেশের মানুষ করবে। আমি যেটুকু পেরেছি, করেছি।
সেই পায়রাবন্দ গ্রামে বসে, সেই মোমবাতির আলোতে সবার নিষেধের মধ্যে উর্দু, আরবী, ফার্সী, বাংলা শিখলেন, ইংরেজী শিখলেন। ওনার ইংরাজী লেখাওত আছে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’। আরও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। অনেক কিছু লিখেছেন। ভালো ইংরাজীও শিখলেন। ভালো বাংলা ত শিখলেনই। আর ছোটবেলাতে উর্দুই ওনাদের ভাষা ছিল। তারপরে বিয়ে করে উনি ভাগলপুরে গেলেন। কিন্তু শ্বশুরবংশ উনাকে পছন্দ করল না। উনি লেখাপড়া জানা মেয়ে বলে। কিন্তু ওনার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন সাহেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। খুব উত্সাহ দিতেন। উনি খুব উত্সাহ দিতেন মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে এবং বেগম রোকেয়াকেও খুব উত্সাহ দিতেন। ‘তুমি লেখ পড়’। তার পরে ত বেশী দিন বাঁচেন নাই। কয়েকটা বছর পরেই ত উনি মারা গেলেন। সাখাওয়াত হোসেন মারা গেলেন। তখন বেগম রোকেয়া স্বামীর নামে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বলে একটা স্কুল ভাগলপুরে করলেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন এত ক্ষেপলেন, এত নির্যাতন শুরু করলেন ওনার উপর যে উনি চলে এলেন। এসে উনি কোলকাতায় ওয়ালী উল্লাহ লেনে ১৯২১ সালে এগারটা মেয়ে নিয়ে একটা স্কুল করলেন। এই ওনার স্কুলের শুরু। একদম বস্তীর মেয়েদের নিয়ে উনি কাজ শুরু করলেন। তখন কোনো ভদ্রলোকের মেয়েরা স্কুলে যায় না। মুসলমান মেয়েরা এই বস্তীতে স্কুল করলো। হিন্দু মেয়েরা, খৃস্টান মেয়েরা সব ওনার কাছে আসত এখানে। এইভাবে আস্তে আস্তে স্কুলটি বড় করলেন। খালি স্কুলটা বড় করা না—যদি উনি সেই সময় এরকম না করতেন তাহলে বোধকরি সমাজও জাগত না। মুসলমান সমাজ কি হিন্দু সমাজ তখন অনেক অন্ধকারে ছিল। বিশেষ করে মুসলমান সমাজ, আমি বলব। হিন্দু মেয়েরা লেখাপড়া শিখে এগিয়ে গেছে। হিন্দু ভদ্রলোকেরা অনেকটা মুক্তবুদ্ধি শুভবুদ্ধি নিয়ে মেয়েদের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু মুসলমান সমাজ ত তখন ওনার একদম বিরোধী। তা সত্ত্বেও উনি সেই স্কুলটা করলেন। সেটাকে বোর্ডিং না বলে একটা অনাথ আশ্রম বলা যেতে পারে।
সেখানে যত হিন্দু মেয়ে, খৃস্টান মেয়ে, নির্যাতিত মেয়েরা, যাদেরকে বাড়ী থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, যারা হিন্দু সমাজ থেকে বেরিয়ে গেছে, ইংরেজ সমাজে যাদের ঠাঁই নাই তারা এসে ওনার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আর মুসলমান মেয়েদের ত কথাই নাই। ওই রকম আশ্রম করে উনি ওই নিজেদের মধ্যেই খুব লেখাপড়া জানা না হলেও ওদের দিয়েই স্কুল চালাতে শুরু করলেন। ওই আশ্রমটা চালাতে শুরু করলেন। আমরা নিজেরা দেখেছি। প্রায় ১৯২৭-২৮ সনে আমি আবার কলকাতায় এলাম তখন এসেই আমি ওনার সাথে দেখা করলাম। তখন গিয়ে দেখলাম সে বিরাট একটা আশ্রম করেছেন। অনেক মেয়ে ওখানে থেকেই লেখাপড়া করছেন। বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। তারপরেও নানান রকম কথা শুরু হল। হ্যাঁ, উনি ত ভালোরকম করে শিখান না, ওনার শিক্ষয়িত্রী যারা তারা ত কিছুই লেখাপড়া জানে না, তারা ত বাপে খেদানো, মায় তাড়ানো। মানে যাদের কোনো সমাজ নাই, সংসার নাই তারা সব ওখানে আছে। সেই জন্য উনি বিএ পাস করা, এমএ পাস করা ট্রেনিং নেওয়া মেয়েদের নিয়ে স্কুলে মাস্টারির কাজে লাগান। আগে কিন্তু উনি সব কাজ নিজে করতেন। আর ওইসব মেয়েদের দিয়ে স্কুল চালাতেন।
আমাকে বড় আদর করতেন। মায়াদি বলে একজন ছিলেন। তার নিজের কথা ত কাউকে বলতেন না। কিন্তু আমরা জানি। হিন্দু সমাজের মেয়ে ডাকাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, পরে আর ওনাকে ঘরে নিত না। বাবা, মা, শ্বশুর বাড়ির কেউই ওনাকে আর গ্রহণ করলেন না। আগে ত এই রকম ছিল সমাজ। সেই বেচারী ছিল সেই আশ্রমে। আমি দেখেছি তাকে, আমরা মায়াদি বলতাম। এখন ত মারা গেছেন। ওই সাখাওয়াত মেমোরিয়ালেই মারা গেছেন। খবর দেওয়া হলো রামকৃষ্ণ মিশনে, ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো, দেখেছি আমরা। তা এই রকম কত যে নির্যাতিত হিন্দু মুসলমান মেয়েরা ছিল।
আর একজন ছিলেন খৃস্টান মহিলা—না দুইজন ছিলেন, তাদের স্বামী, তাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের। ওদের মধ্যে আবার ডিভোর্স নিতে পারে না। কত কিসব হাঙ্গামা-টাঙ্গামা আছে ডিভোর্স নিতে গেলে। কিন্তু স্বামী অত্যাচারী মাতাল মদখোর। বিলাতী মেয়ে, দেশি খৃস্টান না। ব্রিটিশ এই দু’জন মহিলাও ওনার কাছে ছিল। বুড়ি হয়ে গিয়েছিল। মাথার চুল পেকে গেছে। একজন ইংরেজি শিখাতেন, আরেকজন শিখাতেন পিয়ানো। এই দু’জন মহিলাকেও আমি দেখেছি ওখানে। তারা বললেন যে, বেগম রোকেয়ার মতো যদি আরও দু’চারজন মহিলা বাংলাদেশে থাকতেন তবে এই সমাজের খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি হতো।
ওই আদর্শটাই ত আমার মনে আছে। কিন্তু ওই রকম কি আর আমি পারি। কোথায় বেগম রোকেয়া, আর কোথায় আমি। আমার সাধ্যে কি কুলায়? ওনার আদর্শ তো আমার জীবনের সঙ্গে একদম লেপটে গেছে। আর ওই আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম যে উনি করলেন, ওইটার কাজ নিয়ে কলকাতায় বস্তিতে বস্তিতে আমরা কাজ করেছি। সেই সমিতিতে তখন এলেন একদম লেডি গজনবী থেকে শুরু করে লেডি ফারুকী, মিসেস মোমেন, মিসেস গফফার, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ—আমরা সবাই তার সভ্য ছিলাম। খালি বলতেন, দেখ এই যে কাছে আসে যারা, বোরখা পরেই আসুন বা শাড়ি পরেই আসুন বা পায়জামা পরেই আসুন তারা যে এই মিটিং-এ আসে এইটাই খালি উন্নতি না, আসলে আমাদের দেখতে হবে যে আরও যে আমাদের নির্যাতিত বোনেরা রয়েছে, ভাইয়েরা রয়েছে তাদেরকে। তোমরা যাও, তোমরা কাজ কর। এই স্কুলে যতক্ষণ তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে তার চেয়ে তোমরা যদি বস্তীতে গিয়ে আমার ভাইদের, বোনদের বুঝাও তাহলে আমাদের সমাজের উন্নতি হবে। ওরা যদি স্কুলে নাও আসতে চায় তবু ওদেরকে একটু লেখাপড়া শিখাও। আমরা তাই পাড়ায় পাড়ায় গেছি। কত মহিলারা আমাদের সঙ্গে আগ্রহ করে লেখাপড়ার জন্য ঘরে ঘরে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র খুলতে চেয়েছে। কত মহিলা আমাদের সঙ্গে আগ্রহ করে মিশতে চেয়েছে, তা স্বামীরা বলেছে ‘ইয়ে লোগত খারাব আওরাত হ্যায়’, ইয়ে লোগকো মাত আনে দো’ ইয়ে লোগ বস্তি বস্তিমে ঘুমতা। এই কোলকাতার বস্তিওয়ালারা। কিন্তু তবু আমরা গেছি। আবার কেউ কেউ আদর করে বসিয়েছে বোন বসেন, চা খান। আপনারা কেন এসেছেন? এরকম করে আমাদের জিজ্ঞাসা করেছেন।
আমরা হিন্দু মুসলমানদের বস্তীতে ঘুরেছি। ভদ্রলোকদের জন্যও স্কুল ছিল। তারা ত অনেক উন্নতি করেছে। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যেও তখন বস্তীতে এত অনুন্নত সম্প্রদায় ছিল— অচ্ছ্যুত্ সম্প্রদায়ের ছিল বেশি। মুসলমানদের মধ্যে ত অচ্ছ্যুত্ সম্প্রদায় নাই। কিন্তু আমার এখনও মনে আছে আমার প্রথম জীবনে হিন্দু অচ্ছ্যুত্ সম্প্রদায় আমরা তখন দেখেছি, একদম বস্তীতে। ভদ্রলোকদের সঙ্গে যাওয়া-আসা বা ইস্কুল-কলেজে তারা যেতে পারে না। সেইসব জায়গায় বেগম রোকেয়ার আঞ্জুমান থেকে আমরা বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, শিশু শিক্ষাকেন্দ্র করেছি। তবে সেটা কি বিএ, এমএ পাস করাবার জন্য? না—এই প্রাথমিক শিক্ষাটা অক্ষর পরিচয়, একটা চিঠি লেখা, একটু হিসাব লেখা, এই পর্যন্ত আমরা শেখাবার চেষ্টা করেছি। হ

কবি সুফিয়া কামাল রচিত ‘একালে আমাদের কাল’ গ্রন্থ থেকে

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ