প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, June 17, 2011

একজন ফিদা হুসেন ।। জিয়া উদ্দিন সাইমুম

মার্কিন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক জন স্টেইনবেকের একটি কালজয়ী উক্তি কীভাবে যে মকবুল ফিদা হুসেনের জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল, তা ভাবতে অবাকই লাগে। স্টেইনবেকের উক্তিটি ছিল এ রকম :‘ এখানে একটি ব্যর্থতা ঘটেছে, যা আমাদের সব সাফল্যকে ডিঙিয়ে গেছে। এখানে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যা নিন্দার সব ভাষা অতিক্রম করে যায়। এখানে একটি দুঃখ লেপ্টে আছে, যা চোখের পানি দিয়েও চিহ্নিত করা যায় না।’ উক্তিটি এখন মকবুল ফিদা হুসেনের জীবনের শেষ অধ্যায় সম্পর্কে খাটে। কারণ মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংস ভারত’, নেহেরুজির ‘সমাজতান্ত্রিক ভারত’, ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগানে উচ্চকিত ভারতে দেশটির পিকাসো-খ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের ঠাঁই মেলেনি। দেশের মাটিতে মরতে পারলেন না, শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে হলো বিদেশের মাটিতে।
৯৫ বছর বয়সী এই চিত্রশিল্পী দীর্ঘ ৮ বছর স্বেচ্ছানির্বাসনের পর অবশেষে কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন। ‘মেরা ভারত মহান’-এ দ্বৈত-নাগরিকত্বের বিধান নেই বলে তাকে ভারতীয় পাসপোর্ট দোহায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে জমা দিতে হয়।
সাদামাঠা ভাষায় বলা যায়, মকবুল ফিদা হুসেনের অপরাধ তিনটি। প্রথম অপরাধ, তিনি মুসলমান। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় অপরাধ, আন্তর্জাতিকভাবে তিনি প্রতিনিয়ত প্রশংসা পেতেন। এটাও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সহ্য হয়নি। তৃতীয় অপরাধ, তিনি হিন্দু (সনাতন ধর্ম) ধর্মের দেবদেবীদের নগ্নচিত্র অঙ্কন করে পুরো ধর্মটাকেই নাকি নগ্ন করে দিয়েছেন।
এই অপরাধে ফিদা হুসেনের বেশ কিছু শিল্পকর্ম আগুনে পোড়ানো হয়। তার বিরুদ্ধে ধর্ম-অবমাননার মামলা করা হয়। কিন্তু ভারতের সুপ্রিমকোর্ট মকবুল ফিদা হুসেনকে ‘নির্দোষ’ বলে রায় দেন। ঘটনা এখানে থেমে গেলে ভালো হতো। কিন্তু থামেনি। বরং আর্যশক্তির নির্মিত অহংকারে বলীয়ান হয়ে বিজেপি, আরএসএস, শিবসেনা আর বজরং দল ফিদা হুসেনকে কতল করার হুমকি দিতে থাকে। তারা ফিদার লাশের বিনিময়ে প্রায় এক কোটি টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করে। এছাড়া তার নামে অনেক মামলা করা হয়।
নিরুপায় ফিদা হুসেন দেশত্যাগ করলেন। তেলরাষ্ট্র কাতার তাকে আশ্রয় দিল। গত বছর নাগরিকত্বও দিল। কাতারে তিনি দুটো বিশাল প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমটি ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস। দ্বিতীয়টি আরব সভ্যতার ইতিহাস। দ্বিতীয় প্রকল্পটির প্রেরণাদাতা ছিলেন কাতারের ক্ষমতাবান ফার্স্টলেডি শেখ মুজাহ বিনতে নাসের আল মিসনেদ।
তার পরও ফিদা হুসেনের দেশপ্রেম অটুট ছিল। গর্ব আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলতেন, ‘ভারত আমার মাতৃভূমি। পাসপোর্ট সমর্পণ করেছি বলেই দেশের সঙ্গে আমার সব আত্মিক সম্পর্ক চুকে যায়নি।’ কিন্তু হায়! এটা বলার পরও ভারতের প্রগতিশীলরা তার সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারেননি।
গত ৯ জুন লন্ডনের ব্রম্পটন হাসপাতালে মকবুল ফিদা হুসেন মারা যান। ২০০৬ সাল থেকে তিনি তার মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশে অবস্থান করছিলেন।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় এক আধুনিক চিত্রশিল্পী জিটিস কাল্লাত বলেন, ‘ফিদার মতো গুণী শিল্পীর জীবনের শেষ সুবিধাগুলো ভারত নিতে পারল না। এটা ভারতের দুর্ভাগ্য।’
ফিদা হুসেন ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করলেও তিনি জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করতে আগ্রহী ছিলেন না। এ কারণেই ভারতের কাছে তিনি ‘বহির্বিশ্ব নাগরিক’ হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
বলিউডের সুন্দরী তারকারা ছিলেন তার কাছে কলালক্ষ্মী। তাদের অনুরাগী হিসেবে জাহির করা থেকে শুরু করে ছবি আঁকা, এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণেও পিছপা হননি তিনি। তার প্রিয় নায়িকার তালিকায় ছিলেন হালের আনুশকা শর্মা ও অমৃতা রাও ছাড়াও মাধুরী দীক্ষিত, টাবু, বিদ্যা বালান ও ঊর্মিলা মার্তণ্ডকরের মতো ডাকসাইটে তারকারা।
‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ ছবিতে আনুশকা শর্মার কাজ দেখে মকবুল ফিদা হুসেন এতটাই মুগ্ধ হলেন যে ছবিটা বারবার দেখেন। তার ইচ্ছা ছিল আনুশকাকে নিয়ে ‘পাঞ্জাব কি কুদি’ শীর্ষক একটি ছবি আঁকা। ‘ভিবাহ’ ছবি দেখার পর থেকেই অমৃতা রাওয়ের দারুণ ভক্ত বনে যান ফিদা হুসেন। তিনি তাকে মাধুরী দীক্ষিতের পরের আসন দিতে রাজি ছিলেন। ‘ইশক’ ছবিতে বিদ্যা বালানের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হন যে, বলিউডের ওই নায়িকার একটি ছবি আঁকার খুব শখ ছিল তার। টাবুকে নিয়ে মকবুল দ্বিতীয় ছবি ‘মীনাক্ষী’ তৈরি করেন। আর মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে ‘গজগামিনী’ ছবি নির্মাণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, নিজেই এঁকেছেন সম্পূর্ণ সিরিজ। ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ছবি দেখার পর থেকেই বলিউডের ওই শীর্ষ নায়িকার প্রায় অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেন মকবুল ফিদা হুসেন।
এটা ঠিক যে, খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার খবরে ভারতের শিল্পীসমাজে বিভক্তি দেখা দেয়। কূটনীতিক, শিল্পীরা এ নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, আজ ভারতের গর্ব ফিদা হুসেনকে চেনা হবে কাতারের গর্ব হিসেবে, আর আমরা অনুশোচনা করব।
তাদের এসব মতামত নিয়ে ভাবার সময় যে ফিদা হুসেনের, নতুন জগত্ যে তাকে পূর্ণতার দিকে টানছে!
ফিদা হুসেনের জন্ম ১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মহারাষ্ট্রে। প্রায় শতায়ু হলেও আজীবন মনেপ্রাণে ছিলেন চিরনবীন। রাস্তা, স্টুডিও, বাসা—যেখানেই হোক না কেন মেতে উঠতে পারতেন রং-তুলির সজীব খেলায়। অসাধারণ সব শিল্পকর্ম দিয়ে তিনি নাম কুড়িয়েছিলেন দেশ-বিদেশে। ভূষিত হয়েছেন ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৫৫), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৭৩) আর ‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৯১) সম্মাননায়। ১৯৯৬ সালে মনোনীত হয়েছিলেন ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে। বিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী তাঁকে অভিহিত করেছে ‘ভারতের পিকাসো’ হিসেবে।
আগাগোড়া এ চিত্রশিল্পী চলচ্চিত্র নির্মাণেও আগ্রহী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি তৈরি করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘থ্রু দ্য আইজ অব এ পেইন্টার’। সংলাপবিহীন মাত্র ১৫ মিনিটের এ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল ভারতের রাজস্থানের ধারাবাহিক কিছু ছবি নিয়ে। চলচ্চিত্রটি সে বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’ জিতে নেয়। এরপর ৩৩ বছর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেননি।
তিনি ছিলেন বলিউডের চিত্রনায়িকা মাধুরী দীক্ষিতের রূপমুগ্ধ। মাধুরীকে মডেল করে তিনি এঁকেছিলেন অনেক ছবি। মাধুরীকে নিয়েই বানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গজগামিনী’ (২০০০)। এ ছবিতে তিনি নারী, কবিতা, সঙ্গীত আর নৃত্যকলাকে সমন্বয় করেছেন পটে আঁকা ছবির মতো। ছবির নৃত্যপরিচালক সরোজ খানকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার চলচ্চিত্রটি হবে পেইন্টংয়ের মতো। নাচ-গান, সংলাপ, অভিনয়—সব কিছুতেই ছোঁয়া থাকবে রঙ-তুলির।’ অন্যদিকে ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ মকবুল ফিদা হুসেন সম্পর্কে বলেছেন, ‘ভারতে আমরা চলচ্চিত্র বানাতে ও দেখতে শিখেছি গল্প বলার ঢঙে। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেন আমাদের শেখালেন চলচ্চিত্রকে কীভাবে পটে আঁকা ছবি মতো করে উপলব্ধি করতে হয়। গজগামিনী আর মীনাক্ষী দেখার পর চলচ্চিত্রে ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিয়েন্সের গুরুত্বটা দারুণভাবে টের পাওয়া গেল।’
মুম্বাইয়ের রাস্তায় সিনেমার হোর্ডিং এঁকে জীবিকা শুরু করেছিলেন হুসেন। আধুনিক টেকনিকের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয় প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হোসেন জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছিলেন রামায়ণ মহাভারত অবলম্বনে কয়েকশ’ ক্যানভাস আঁকার কাজে। তাঁর দেশত্যাগ ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক দুর্বলতাকে সামনে এনেছে।
এমনিতেই তিনি হিন্দু মৌলবাদীদের তোপের মুখে ছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে নগ্ন ‘ভারত মাতা’ ছবিটি আঁকার পর থেকেই চূড়ান্ত তোপের মুখে পড়েন তিনি। এই ছবিতে ভারতের মানচিত্রটিকে একটি নগ্ন নারী হিসেবে দেখানো হয়েছে, আর যার দেহের নানা অংশে ভারতের বিভিন্ন স্থানের নাম লেখা হয়েছে।
২০০৮ সালে এক মামলায় বলা হয়, হুসেনের ভারতমাতা চিত্রটি অশ্লীল নয়, এটি কাম উদ্দীপকও নয় এবং এই চিত্র কোনো বিকৃত কামনার উদ্রেক করে না। চরম দুর্দশাগ্রস্ত একজন নারীর বিমূর্ত চিত্রের মাধ্যমে জাতির একটি অবয়ব দেখাতে চেয়েছেন তিনি। আর শিল্পীর দাবি ছিল, চিত্রটির নান্দনিক নগ্নতা অশ্লীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। চিত্রটি কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে না। 


No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ