প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Wednesday, June 22, 2011

সংগ্রামী নারী বেগম সুফিয়া কামাল ।। ছালেহা খানম জুবিলী

নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত্ কবি বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি সবার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ধন্য। তার কবিতা ছোট-বড় সবাইকে অনুপ্রাণিত করে, মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর নারী জাগরণের সঙ্গে এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিচিত্র ইতিহাসের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালের নাম নিবিড়ভাবে জড়িত। কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিন ২০ জুন পালিত হলো। কবি সুফিয়া কামালের জন্ম ১৩১৮ সালের ১০ আষাঢ় (২০ জুন ১৯১১) শায়েস্তাবাদের এক নবাব পরিবারে। সুফিয়া কামালের জীবনটাই ছিল সংগ্রামের। তিনি যখন ছোট্ট শিশু, তখনই তার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শৈশবেই তিনি চলে আসেন মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ি। মাতুলালয়ে প্রচুর বিলাস-বৈভব, আদব-কায়দা ও কঠোর রক্ষণশীল পরিবেশে তিনি লালিত হন। সুফিয়া কামালের যে সময় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, সে সময় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে সে সময়টা নারী-শিক্ষার ছিল ঘোরবিরোধী। কিন্তু অদম্য স্পৃহা এবং জ্ঞান-বাসনা তাকে দমাতে পারেনি। তিনি সীমাবদ্ধ আঙ্গিনা ভেঙে বেরিয়ে আসেন। সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা পাননি। তার বড় মামার বিশাল লাইব্রেরিতে মায়ের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করতেন। এভাবেই তার বিদ্যাচর্চার পরিধি বাড়তে থাকে। সে সময় পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বেগম রোকেয়া ও সারা তৈফুরের লেখা পড়ে তার সাহিত্য সৃষ্টির অভিলাষ জাগে এবং তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
কবি সুফিয়া কামালের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন বড় মাপের কবি এবং স্বৈরশাসনবিরোধী সাংস্কৃতিক নেত্রী ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ’ পত্রিকায় সৈনিক বধূ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে। সুফিয়া কামালের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে তারই মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি শায়েস্তাবাদ ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে বরিশালে চলে আসেন এবং পরে স্বামীর সঙ্গে কলকাতা চলে যান। এসেই পরিচিত হয়েছেন সাহিত্য সমাজে। পূর্ব পরিচয় থাকলেও কলকাতায় আসার পর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৯৩২ সালে স্বামী নেহাল হোসেন মারা যাওয়ার পর তিনি মর্মাহত হন। সেই সঙ্গে পারিবারিক অসহযোগিতা সইতে না পেরে তিনি এক হাতে বিধবা মা, অন্যহাতে কন্যাশিশুটিকে নিয়ে অন্যত্র চলে আসেন। শুরু হয় তার কঠিন এবং সংগ্রামী জীবন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি চলে তার সাহিত্য চর্চা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুফিয়া কামালকে সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ পরিচয় কবির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার প্রথম গল্প ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো—সাঁজের মায়া, একাত্তরের ডায়েরি, মায়া কাজল, উদাত্ত পৃথিবী, ইতলবিতল, কেয়ার কাঁটা ও সোভিয়েত দিনগুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে। ১৯৩৯ সালে তার আবার বিয়ে হয় কামালউদ্দীন খানের সঙ্গে। শুরু হয় তার আবার নতুন জীবন। কামালউদ্দীন ছিলেন প্রগতিবাদী সাহিত্যপ্রেমিক। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি শুরু করেন সমাজকর্ম ও জনসেবা। বরিশালে মাতৃমঙ্গল সেবাসদনের কাজ দিয়ে সুফিয়া কামালের সমাজসেবী কর্মজীবনের শুরু হয়।
কবি বেগম সুফিয়া কামাল নারী জাগরণ এবং আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার জীবনই ছিল কর্মময়। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, আপসহীন নেত্রী। এই ছোট্ট পরিসরে তার ব্যাপক কর্মময় জীবনের খুব সামান্যই তুলে ধরা হলো। সুফিয়া কামাল ১৯২৫ সালে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি বরিশাল এলে তিনি নিজের চরকায় সুতা কেটে গান্ধীজির হাতে তুলে দেন। তিনি ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্য মনোনীত হন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে তিনি কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতায় লেডি ব্রেবোন কলেজে আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়োজন এবং মিছিলে নেতৃত্বসহ সামগ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তার নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী নিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ করার প্রস্তাব পেশ করা হয়।
১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠন এবং সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা শহরেই অবরুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন। সুফিয়া কামাল একজন মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। এদেশের অবহেলিত, নির্যাতিত, শোষিত নারীসমাজের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নারীদের সাহসী, সংগ্রামী এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বেগম সুফিয়া কামাল জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ সংগ্রামী মহীয়সী নারী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার সংগ্রামী এক সাহসী কর্মময় জীবন বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। তার লেখা গল্প, কবিতা, ছড়া আমাদের মনের মণিকোঠর থাকবে জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়ে। আসছে ২০ জুন আমাদের সবার প্রিয় কবির জন্মদিন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। 

সূত্র : আমার দেশ

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ